অতএব, রাজা বলিলেন, অতিমারিতে মানুষ মরিতেছে কেন? ডাক্তার বদ্যি কি কোনও কর্মের নয়? বিদূষক বলিল, তারাও যে মরিতেছে। রাজা দেখিলেন এ তো বড় জ্বালা! এ কেমন অসুখ যে ডাক্তার-বদ্যিও মরিতেছে? বলিলেন, এরা কী খায়? পাঁপড় খায় না? এদের অনাক্রম্যতার এই দশা! নিন্দুকে বলিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরেও যে অতিমারিতে ধরিয়াছে। ওদিকে উত্তর প্রদেশের মন্ত্রী… রাজা বলিলেন, থাক থাক। ওসব বাজে কথায় কান দিও না। এখন ভগবানই ভরসা। মন্দির বানাই।
মিনমিন করিয়া বিদূষক বলিল, দেশে অতিমারিতে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। রাজা বলিলেন, “এই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হউক, যবন-বিদ্বেষ প্রচার হউক। ঘন্টা বাজুক, কাঁসর বাজুক। জয়ধ্বনি দাও! সব অসুখ হইবে খানখান।”
কতগুলি ভুখা যুবক আসিয়া রাজদরবারের এক কোণে বসিয়া ছিল। রাজার কেতাদুরস্ত হাবভাব দেখিয়া ঠাওর করিল রাজা শুধু ধার্মিকই নন, দিলদারও বটে। তারা হাত জোড় করিয়া বলিল, “রাজামশায়, বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্ব দিকের মানুষ বিধ্বস্ত। আপনার কাছে সংবাদ আসেনি দেখে আমরা ছুটে এলাম।” রাজামশাই তাদের দিকে চেয়ে বলিলেন, “আহা রে দুঃখী! আমরা মন্দির বানাচ্ছি। চলো, করসেবকের দলে নাম লেখাও।” ভুখা যুবকেরা স্তম্ভিত হইয়া বলিল, “আমাদের যে বন্যায় ভেসে গেছে গ্রামকে গ্রাম!” রাজা বলিলেন, “জোরসে বল জয় শ্রীরাম।”
যাদের মাথায় খানিক বুদ্ধি ছিল, তারা এদিক ওদিক না করিয়াই বলিল, “মন্দির হইবে। এ তো আনন্দের কথা। তা অতিমারি কাটিয়া গেলে কি সুসময় আসিবেনা প্রভু? অতগুলি টাকা দিয়ে চিকিৎসা করালে কাজ হয়!” পারিষদের চোখ লাল। “কী? যত বড় কথা তত বড় মুখ নয়! এইই হল শুভক্ষণ। ঠিক এই দিন — বিলক্ষণ। মনে নাই উত্তুরে উপত্যকায় গেল বৎসর, রাজার বাহিনী গিয়ে চেপে দিল সব বেটার গলার স্বর? টু হেল উইথ ৩৭০! যবনেরা যবে উৎসব করিল, তবে অতিমারি পড়েনি ধরা?” বুদ্ধিমান বলিল, “ইয়ে মানে, সে উৎসব তাহাদের নিজেদের টাকায় করা। সরকারি টাকা, জনগণের করের টাকা। তাহাতে জনগণের রয়েছে হক।” বিদূষক হাঃ হাঃ হাসিয়া বলে, “এই দেশে? ক্ষেপেছ? আহাম্মক, আহাম্মক!”
সান্ত্রী খবর দিল, “নিন্দুক শিক্ষকগুলি বলিতেছে নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষার্থীরা কেবল কোম্পানীর হাতের পুতুল হইবে। তারা প্রশ্ন করিবে না, ভাবিবে না, কেবল জপিপে কোম্পানির নাম!” রাজা চোখ কটমট করে বলিলেন, “গারদে ভর। অউর জোরসে বল জয় শ্রীরাম!”
ভিড়ের ভিতর কেহ বলিল, “আর প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে সেই বেলা?” রাজা বলিলেন, “UAPA দাও, এসব কথা কেন? ছেলেখেলা?”
নিন্দুক বলিল, চাকরি নাই। রাজা বলিলেন, “ওইখানেই মন্দির চাই!” নিন্দুক বলিল, “অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়।” পারিষদ বলিল, “মন্দির বনিতেছে, আবার এরা কী চায়?” নিন্দুকে বলিল, “পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ নাই!” রাজা বলিলেন, “শত্তুরের মুখে ছাই। জয়শ্রী রাম, জয়শ্রী রাম।” প্রান্তিক মানুষ বলিল, “আমাদের মেরো না, মেরো না। আমরাও তোমাদের, আমরা আম!” পারিষদ বলিল, “আগে বল্ বিধর্মী, জয় শ্রীরাম!” বণিক বলিল, “এদের থামাও দিকি। নইলে আর রক্ষে নেই।” রাজা বলিলেন, “যথা আজ্ঞা প্রভো… I mean, সেই সেই!”
পতাকা উড়িল। রাজামশাই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন দেববিগ্রহ। সাধকেরা পূজা করিল, পারিষদরা ভাণ্ডার লুটিল, বণিক লুটিবার প্রশস্ত ফাঁদ প্রস্তুত করিল, মুখ্যু ভক্তের দল য়্যাব্বড় বাক্সে জয়ধ্বনির গান চালিয়ে নাচিতে লাগিল। সেই জগঝম্পে চাপা পড়িয়া গেল একটা আস্ত দেশ।
Unfortunate situation and unfortunate we!
LikeLiked by 2 people