[To read the same in English.]
আপনি কখনও কেক খেয়ে বলেছেন, “এই খেলাম। খেতে কেমন জানি না”? বা কখনও একটা শার্ট কিংবা শাড়ি গায়ে চাপিয়ে বলেছেন, “এই পরলাম, কেমন লাগছে তাই নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই”? বলে থাকলে আলাদা বিষয়, কিন্তু যদি না বলে থাকেন, তার অর্থ হল আপনার একটা নিজস্ব স্বকীয় মতামত আছে এবং তা বেশ জোরদার। আছেই যখন, তখন আপনার বেঁচে থাকার মূলগত বিষয়গুলিতে সেই মতামতের জোরালো উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন, যাতে এই বিষয়গুলি সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত আপনিই নিতে পারেন।
গোড়ার কথা
বিষয়টা বোঝাতে পারলাম না তো? বেশ, এখন তো লকডাউন চলছে। গৃহবন্দী। কেউ কেউ বাড়ি থেকে কাজ করছেন, কারো কারো অখণ্ড অবসর। একবার ভেবে দেখুন তো, কিসের ওপর নির্ভর করে দিনযাপন করেন আপনি? খুব ভেবেচিন্তে দেখলে বুঝবেন, লকডাউন হোক বা উৎসবের সময়, দোকান-বাজারে হোক বা অটোর লাইনে — মানুষ বেঁচে থাকে সম্পর্কের ওপর। এই লকডাউনেই দেখুন না — রেশন নিতে হবে, বাজার করতে হবে, দোকান থেকে মাসকাবারি আনতে হবে, অথচ আপনি বাইরে বেরোতে পারছেন না। হাসিমুখে পাড়ার থেকে বুল্টু, ভোলা আর বাবাই এসে বলল, “আমাদের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে সমস্ত দোকান-বাজার আপনার বাড়ি পৌঁছে যাবে বৌদি। চিন্তা নেই দাদা, আমরা এই সময় আপনাদের পাশে আছি।” এই পাশে থাকার পাঠ, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খুবই জরুরী। একা আপনি কিচ্ছুটি নন। আপনার দৈনন্দিন বেঁচে থাকা আসলে কিছু আদান-প্রদান জনিত সম্পর্কের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
এবার এই সম্পর্কগুলো কেমন হবে? কেমনই বা হবে তাদের বিনিময় পদ্ধতি, আকার বা নিয়মকানুন — সেই সিদ্ধান্ত নেয় কে? আপনার দেশের প্রশাসন। জনগণতান্ত্রিক দেশে এই প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন বিভিন্ন সময়ে ঠিক করে দেন বিভিন্ন নির্বাচিত সরকার এবং নির্বাচনের পর সেই সমস্ত আইন যাতে সঠিকভাবে বজায় রাখা হয়, প্রশাসনিক এবং আইনী ক্ষেত্রে যাতে যে কোনও রকম সমস্যায় সে আইনগুলির সঠিক প্রয়োগ হয় তা সুনিশ্চিত করার শপথ নেন। এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, গণমাধ্যম, অর্থাৎ মিডিয়া কী করে? তাদের কাজ হল, এই সমস্ত ঘটনাকে গুছিয়ে সংবাদ আকারে জনতার সামনে পেশ করা, যাতে বাকি তিনটি স্তম্ভ অর্থাৎ কার্যনির্বাহী বিভাগ, নির্বাচিত প্রতিনিধি বিভাগ এবং বিচার বিভাগের আন্তঃসম্পর্ক এবং তার খুঁটিনাটি সম্পর্কে জনগণ ওয়াকিবহাল থাকেন।
এই তিনটি স্তম্ভ মূলগত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে আপনার ভোটের উপর। চতুর্থটি নির্মিত হচ্ছে আপনারই তথ্যের চাহিদা পূরণের জন্য। অতঃপর এই চারটি স্তম্ভ আপনার জন্যই কাজ করে চলে নিরন্তর (মানে ব্যাকরণ তাই বলছে)। এবং এই চারটি স্তম্ভের সঙ্গে আপনার সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র উপায় হল — রাজনীতি।
রাজনীতি খায় না মাথায় মাখে?
বিরিয়ানী খাবেন? চাল কিনতে যাচ্ছেন। যা দাম বেড়েছে বাসমতীর কদিন ইস্তক। এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তায় বেরিয়ে দেখলেন বাড়ির সামনের ড্রেনের জল বড্ড নোংরা। মশার ঝাঁক। কোনমতে পাশ কাটিয়ে খানিক এগিয়ে দেখলেন, চারটে স্ট্রীটলাইটের মধ্যে একখানা গত তিন সপ্তাহ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু কার কী এসে যায়? অধৈর্য হবেন না। মন দিয়ে ভাবুন, ওই বাসমতী চালের মূল্যবৃদ্ধি, ওই নোংরা ড্রেনের মশার ঝাঁক, রাজ্যজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ, খারাপ হয়ে পড়ে থাকা স্ট্রীটলাইট — আপনার প্রাত্যহিকতার প্রতিটি দিক জুড়ে রয়েছে রাজনীতির সক্রিয় সহাবস্থান। অতএব আজ পাঁচ মিনিট আগে অবধিও যে আপনি ভাবছিলেন, যে আপনার অত ‘রাজনৈতিক কচকচি’ পোষায় না, আপনি আদ্যোপান্ত অরাজনৈতিক — সে ব্যাপারে আরেকবার ভেবে দেখুন। কোনও মানুষ জন্ম ইস্তক কখনই অরাজনৈতিক হতে পারে না। রবিনসন ক্রুসো হলেও না — কারণ তাঁকেও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করতে হয়েছিল এবং সেটিও একটি রাজনৈতিক অবস্থান।
রাজনীতির প্রতি ঘৃণা অথবা ঔদাসীন্য আসলে আপনার জীবনের মৌলিক শর্তগুলির প্রতি ঘৃণা অথবা ঔদাসীন্যের প্রতীক স্বরূপ। এবং এই মৌলিক শর্তগুলিকে অস্বীকার করা আসলে হয় মূর্খামি, নয় ভন্ডামি। আপনার প্রতিটি বেছে নেওয়া আসলে একটি রাজনৈতিক অবস্থান, এমনকি আপনার নিজেকে আপাত ‘অরাজনৈতিক’ ঘোষণাও।
আসলে অরাজনৈতিকতা কোনও বাস্তব বিকল্পই নয়। যতক্ষণ আপনার জীবনের মৌলিক সম্পর্কগুলি বিদ্যমান, আপনার পক্ষে অরাজনৈতিক হওয়া সম্ভব নয়। আপনার অস্তিত্বই গুরুতরভাবে রাজনৈতিক। ক্যারল হ্যানিশের সেই অমোঘ উক্তি আসলে প্রতিটি মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিক: “The personal is political, and the political is personal.” ব্যক্তিই রাজনীতি — যা কিছু রাজনৈতিক তা সবই ব্যক্তিগত। হ্যাঁ, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের নির্যাতনের অভিজ্ঞতা, কিংবা অন্যায়-অবহেলা, আপনার ব্যক্তিগত অধিকার — সমস্তকিছুই রাজনৈতিক।
আপনি বিধানসভা ইলেকশনের টিকিট পেয়েছেন?
এই তো! এবার আপনি সেই প্রশ্নটা করে ফেলেছেন, যে আমি রাজনীতি করি, অতএব আমি ভোটে দাঁড়াব কিনা। আসলে, নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ বলে ভাবতে ভাবতে সহজেই এমন একটা জায়গায় দাঁড়ানো যায় যেখানে রাজনীতি আসলে জল খাওয়া, বাথরুম যাওয়া, ঘুমানো, হাঁটা-চলার মতোই সহজ একটা বিষয় সেটা বোঝার জায়গাটাও ঝাপসা হয়ে আসছে দিনকেদিন। রাজনীতি শব্দটিকে ভীষণ সহজেই আমরা ক্ষমতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। নির্বাচনী রাজনীতিকেই একমাত্র রাজনীতি বলে ভুল করি। নির্বাচনী রাজনীতি রাজনীতির একটি শ্রেণীবিভাগ তা ঠিক, কিন্তু ওই শ্রেণীবিভাগ মাত্রই। বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ের সংযোগ যতটা, তার চেয়ে অধিকারের লড়াইয়ের সংযোগ অনেক বেশী। আজ্ঞে হ্যাঁ — আপনার রাজনীতি সম্পর্কে আপনার সচেতন হবার দরকার এই কারণেই। আপনার অধিকার আপনাকে সমাজে বাঁচিয়ে রাখে, জায়গা দেয়, আপনার বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। সেই অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্যই আপনার রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া জরুরী। যে মুহূর্তে আপনি নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন হবেন, তখনই আপনি বুঝবেন গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিকগুলি কীভাবে আপনার জীবনে জড়িয়ে আছে। এবং সেখানেই আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সূচনা। এমনকি আপনার রাজনীতি ব্যক্তিগত স্তর থেকে নির্বাচনী স্তরে যাবে কিনা, ক্ষমতা ভিত্তিক হবে কিনা, সেটাও একটা প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক প্রশ্ন। রাজনীতি আসলে আপনার বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানের সঙ্গে আপনার সংযুক্তির মাধ্যম, এবং এই সংযুক্তিই আপনার রাজনীতি।
ধরুন, আজ আপনার পাশের পাড়ায় অন্যায় কিছু হচ্ছে — আপনি চুপ করে রইলেন। আপনার তো কিছু না, কী যায় আসে? আর আপনি তো বলছেন না কিছু, চুপ করে আছেন। ছোটবেলা থেকে জেনেছেন, “বোবার শত্রু নাই।” ভুল জেনেছেন দাদা! হ্যাঁ, ভুল জেনেছেন ম্যাডাম! কিছু ক্ষেত্রে আপনার নীরবতার চেয়ে সোচ্চার রাজনৈতিক অবস্থান আর হয় না। মনে রাখবেন, কাল আপনার দরজায় যখন অন্যায় এসে কড়া নাড়বে, আপনার পাশের পাড়াও কিন্তু নীরব থাকবে। রাজনৈতিক অবস্থান করোনার চেয়েও ছোঁয়াচে।
তবে আমি কোন পার্টি?
এবার আসা যাক রাজনৈতিক দল প্রশ্নে। রাজনৈতিক দলগুলি হল নির্বাচনী রাজনীতির চালক-বাহক-ধারক। এই দলগুলিই তৃণমূলস্তরে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাদের অভাব-অভিযোগের বিনিময়ে জেতা-হারা, ক্ষমতার যোগ-বিয়োগ বুঝে নেয়। সব দলই সমান নয়। মূল রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এই ক্ষমতা বিলাসের মাত্রা আলাদা। কিন্তু রাজনৈতিক হতে গেলেই যে কোনও একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে হবে, অথবা কোনও দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হতে হবে এর কোনও অর্থ নেই। ভারতবর্ষের মত সুবিশাল দেশে যেখানে রাজনীতির এতগুলি সামাজিক অক্ষ কাজ করে, সেখানে এ ধরণের ধারণা অকার্যকর। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতির ধারণার মূলে অবশ্যই কোনও নির্দিষ্ট মতবাদের প্রভাব থাকতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত অবস্থান ঠিক করার মালিক আপনি।
মতবাদ একরকম, জীবন আরেক রকম
আরেকটা ভুল ভাবনা। যে মতবাদে বিশ্বাস করেন সেটা আপনার যাপনে ফুটে ওঠা জরুরী। যে কোনও মতবাদই নিজস্ব যাপনে বজায় রাখা যায়। আপনাকে আপনার রাজনীতি প্রচার করতে হবে না। আপনার জীবনধারায়, যা কিনা আপনারই হাতে, আপনার নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন দেখান। সেটা আসলে ভাষণ দেবার চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর। শুধু নিজের রাজনৈতিক অবস্থানে শিরদাঁড়া ঋজু করে দাঁড়ান, নিজের অধিকার বুঝে নিন।
আজও যদি ‘অরাজনৈতিক’ স্ট্যাম্পটাকে ঝেড়ে ফেলে নিজের অবস্থান জোরালো গলায় না বলেন, দেখবেন একদিন অন্য কেউ এসে বলে দিচ্ছে, কেকটা কেমন খেতে। অথবা জামাটা পরে কেমন লাগছে এবং আপনি স্রেফ অরাজনৈতিক বলে ঘাড় নেড়ে যাচ্ছেন…