©️ ঊষসী ভৌমিক [2018]
সালটা ১৯৩৩, মানুষটি ডঃ সি. ভি. রমন, এবং যিনি অপেক্ষায় ছিলেন তিনি ডঃ কমলা সোহানি। শুধুমাত্র মহিলা অপবাদে তাঁর পি.এইচ.ডি-র আর্জি খারিজ করেছিলেন ডঃ রমন। লোকে বলবে, আসলে তখন যুগটাই এমন ছিল, পুরুষতান্ত্রিক। কিন্তু যুগ ধরে আরো পিছিয়ে যাই, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় — এই মানুষগুলোও তো পুরুষ ছিলেন অথচ এই পুরুষেরা তাঁদের একাকী তন্ত্র সাধনায় নারীদের বাঁচার আলো দেখিয়ে গেছেন। আজ আমার কলমের কালি যা লিখছে তা প্রকৃতপক্ষে আমার নিত্য সম্মুখীন হওয়া কিছু প্রশ্ন।
আমাদের জীবিকা নাকি বুদ্ধি নিয়ে। অন্যান্য প্রাণীদের সাথে মানুষ নামক প্রাণীর প্রভেদ কিন্তু এই চিন্তার জায়গাতেই। অথচ চিন্তাই আবার মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। চিন্তার প্রতিফলন হয় মানুষের কথায়, খুব ছোট ছোট মূল্যবোধে, এবং খুবই সাধারণ ব্যবহারের মাধ্যমে। যাঁরা ভাবেন, এবং বড় বড় রচনার সৃষ্টি করেন এই ভেবে যে মেয়েদের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় শুধুমাত্র কন্যা সন্তান হত্যার মাধ্যমে কিংবা পর্দাপ্রথার আড়ালে, তাঁরা ভুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে আমাদের স্যারেরা প্রায়ই গর্ব করতেন এই বলে, যে এখন ক্লাসে ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এটা যে আসলে গর্ব নয় একটা বিশাল প্রভেদ, সেটা কোনো শিক্ষকই বুঝে উঠতে পারলেন না। ছাত্রদের জিজ্ঞাসা থাকলে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু ছাত্রীরা জিজ্ঞাসা নিয়ে গেলে তাদের অন্য একটা ‘intention’ থাকে। মেয়েদের ভালো নম্বরের পেছনে শুধু মস্তিষ্কের ধূসর অংশ দায়ী নয়, তার কৃতিত্ব তো মেয়ের শরীরের বিভিন্ন বাঁকের। সময় বা যুগ যা নিয়ে গল্প শুরু করেছিলাম — সেটা কি সত্যি এগিয়েছে? প্রশ্ন রইল, কেউ যদি উত্তরটি জানায় তাহলে সত্যিই কৃতার্থ হবো।
তবু আমি বলবো না যে সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। কেন বলব? আমার আজ যতটুকু চিন্তাভাবনা, শৈলী, পড়াশুনো, তাতে পুরুষদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। আমার বিরোধ হলো এই নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নিয়ে।
খুব মুষড়ে পড়েছিলাম গত তিন-চার বছরে বিভিন্ন প্রশ্নবাণ ও ব্যাঙ্গের সম্মুখীন হয়ে। ১৬.৭ গুন ১.৫ -এর উত্তর এক মিনিটে বলতে না পারলেই মেয়েরা নাকি অঙ্কে ‘কাঁচা’। পিঠ অবধি চুল ঘাড় অবধি দৈর্ঘ্যে এলেই ‘ভাই’ নামকরণ হয়ে যায়। আবার ছেলেদের চুল ঘাড়ে নামলে তারা হয় ‘লেডিজ’। বিয়ে হয়ে গেলেই ‘বৌদি’ হয়ে যায় পরিচয়। সামাজিক সমস্যা হওয়া উচিত ধূম্ৰপান, নাকি মেয়েদের ধূম্ৰপান? ধোঁয়া বোধ করি পুরুষ বা নারীর ফুসফুস বিচার করে প্রভাব ফেলে না।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অনেক সুপুরুষ ছিলেন। এগিয়ে ছিলেন এখনকার পুরুষদের তুলনায়। তবে কোথায় যুগ এগোচ্ছে? নাকি বিজ্ঞানের ভাষায় “Retrogressive Metamorphosis” হচ্ছে আমাদের? নামের পেছনে ডিগ্রীর সংখ্যা বাড়ার সাথে মননশীল চিন্তাভাবনা যে সমানুপাতিক না, তা আগেই বুঝেছি। দিনে দিনে শুধু এর বিশ্রী কঙ্কালসার রূপটা প্রকট হচ্ছে। অথচ বাঙালি জাতি তো সর্বদাই বিশ্বের সবপ্রান্তে আধুনিক ও রুচিশীল মননের জন্যে প্রশংসিত। যে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী একজন নারী, সেই দেশের মেয়েদের রোজ স্বপ্রতিরক্ষায় নামতে হয় সন্মান বাঁচাতে। সম্মান কখনো শরীরের, কখনো স্বাধীনতার, বা কখনো চিন্তাশক্তির।
নাঃ, কিন্তু দেশ আমার এগিয়েছে। জাতি আমার গর্ব। যেখানে মেয়েরা তাদের আয় সঞ্চয় করে গয়না বানানোর জন্যে, সংসার খরচ তো বর দেবে। একটি মেয়েকে যখন অপমান করা হয় তখন চুপ করে সেই মনোরঞ্জনের অংশীদার হয় সবাই। তাতে নারী পুরুষের সংখ্যার খুব তফাৎ পাইনি।
নারীবাদী আন্দোলন কি এর সমাধান? আবার প্রশ্ন রাখলাম। আসলে কি জানেন তো মশাইয়েরা, যতক্ষণ শিক্ষিত সমাজের লোকেরা বলবেন “আচ্ছা রবীন্দ্রনাথের তো ওর বৌদির সাথে কি সব ছিল না?”, ততদিন যুগ এগোবেনা, পিছোবে।
তবু আমি বলবো না সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। সমাজকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে কিছু কু-চিন্তাভাবনা। ভুক্তভোগী আমরা। আমি জানি অনেকেই আজ এই শব্দগুলির মধ্যে নিজেদের অভিজ্ঞতা খুঁজে পাবেন। আমি একা লড়ছি না। সকলে লড়ছে। কিন্তু নারীত্ব প্রমাণ করার জন্যে লড়ে লাভ নেই বিশেষ। লড়াই দরকার মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। ‘লেডিস় এর সিট’ বা ‘লাইন’ -এর দরকার যতটা তার চাইতে বেশি দরকার একটা সমাজব্যবস্থার যেখানে ‘লেডিস়’-দের মানুষ করা হবে সব কাজের জন্যে। তবেই হয়তো ‘বুদ্ধিজীবি’ পুরুষ সমাজের কাছেও তাঁদের সম্মান এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। নইলে কিন্তু এই প্রথা সমানে চলবে।
মানবতন্ত্রে বিশ্বাসী এক পুরুষ আমায় শিখিয়েছেন জীবনকে পেয়াঁজের মতো ভাবতে আর জীবনের শিক্ষাগুলো বা মানুষগুলোকে priority-wise ভেতরের খোসায় রাখতে। আমার প্রশ্নগুলোর সমাধান না পাওয়া অবধি হয়তো এটাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এই চিন্তাতান্ত্রিক সমাজে। কিন্তু সময় হয়তো আবার সেদিনই এগোবে যেদিন প্রতিটি মানুষ বা মানুষের চিন্তাশক্তি গোলাপের পাঁপড়ির মতো হবে। বাইরে থেকে ভিতর — সব স্তরই থাকবে, কিন্তু প্রতিটি পাঁপড়ি সুন্দর ও বর্ণময়।
এই লেখাটা খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না কারোর মধ্যে, বিশেষতঃ বুদ্ধিজীবি সমাজে, তা জানি। ওই যে, বুদ্ধিই মানুষের প্রধান অস্ত্র। সেই বুদ্ধি দিয়ে এই লেখার প্রতিটি চিন্তার বিপক্ষে প্রতিচিন্তা তৈরী করে ফেলবেন পাঠকসমাজ। আর তারপর কাগজ ভাঁজ করতে করতে হাঁক পড়বে ‘সকালের খাবার’ সাজিয়ে দেবার। মস্তিষ্কে অনেক আগেই প্রতিচিন্তার দেওয়াল গড়ে উঠেছে। যেখানে একটাই কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, “আজকালকার মেয়েরা সব শ্রীহীন, কি সব আধুনিকতা করে করে গেল।”