“রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।” বাঙালিও মানুষ হয়। বাঙালি শেখে বাংলার মাটি থেকে যোজনমাইল দূরে, ভিন্ন বৈদেশিক পরিবেশে মানিয়ে নিতে। জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করতে। ভোর রাতের কনকনে ঠাণ্ডায় অবাঙালি ভারতীয়কে তার গন্তব্যের বাসে তুলে দিয়ে নিজেরটার জন্য অপেক্ষা করতে। ভিজে হাওয়ায় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া নাকে বাঙালি তবু একটাই গন্ধ পায়: পূজোর গন্ধ। বাঙালিকে বাংলা থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া যেতেই পারে, মানুষ করা যেতেই পারে, কিন্তু বাঙালিয়ানা কেড়ে নেওয়া যায় না।
রাত সাড়েচারটেয় ডার্মস্টাড্ট শহরে পৌঁছে পুরনো বন্ধুকে দেখে স্বস্তির আশ্বাস পেলাম। মনে মনে তখন হিসেব চলছে, এতক্ষণে আমাদের পাড়ার পূজোর কলাবৌ গঙ্গাস্নানে বেরোলো বলে। এদিকে আমাদের মধ্যরাতের গন্তব্য ডীবুর্গ, বন্ধুর বাসস্থান। কিছু ঘণ্টার ঘুম সেরে এবার ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি। ছেলেরা থার্মালের ওপর পাঞ্জাবি-জীন্স, আর মেয়েয়া শাড়ির ওপর জ্যাকেট। পথে লক্ষ্য করলাম জার্মানির কাশফুল, আর মন উঠল মেতে।
আমাদের জন্য শেষ পর্বের পুষ্পাঞ্জলির পর্ব মিটিয়ে, এবার মহাসপ্তমীর আরতি। ঢাক আর কাঁসরঘণ্টার বাদ্যে আর উলুধ্বনির স্বরে মন বলে উঠল, এই তো শারদীয়া। স্থানটা পশ্চিম ফ্রাঙ্কফুর্টের “হরি ওম মন্দির”। আদি সার্বজনীন দুর্গোৎসব, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত।
আরতির পর সপ্তমীর ভোগ। বছরঘুরে বাড়িতে যতই বাঙালি রান্না করা হোক না কেন, ভোগের রানার স্বাদটাই আলাদা! ছোট্ট জায়গায়ে সবকটি মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ, কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা, গল্প, আলাপ, পরিচয়, ঠাট্টা। যেন নিজের পূজো, সবার পূজো, বাড়ির পূজো।
ঠাকুরঘরের এক দেওয়াল জুড়ে রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠের প্রতিটি পাতা টাঙানো রয়েছে। সিলিং থেকে ঝুলছে কাগজের পাখিরা। আর একটি দেওয়াল খালি খালি লাগছে বলে সেটা সাজাতে লেগে পরল আমার বন্ধুরা। রঙীন কাগজে সাজানো হল ঢাক আর কাশফুলে।
বিকেলের চায়ের পর রাতের ভোগের তোরজোর। ছোট্ট রান্নাঘরে মহাউদ্যোগে সচল গতিতে চলতে থাকল বারোয়ারি পূজোর ভোগরান্না। বাইরের উঠোনে ক্ষুদেদের হুটোপাটি, আর তাদের সামলাতে তাদের বাবামায়েদের প্রবল পরিশ্রম! সকল বয়েসের মানুষের সমাগম। ছোটবেলা থেকে আমার কাছে পূজো মানে অনেক ঘোরা আর ঠাকুর দেখা। তাই এইবারের পূজোটা দেশের বাইরে প্রথম পূজো বলেই নয়ে, প্রকৃতপক্ষেই আলাদা।
ঠাকুরঘরে আমাদের ইকিরমিকির খেলা শেষ হতে শুরু হল ত্রিদলীয় অন্তাক্ষরি। পরিবেশ জমজমাট! তারপর সবাই মিলে অষ্টমীর ভোগের আনাজ কেটে, নির্ভেজাল আড্ডা মেরে, নিরন্তর বাংলায়ে কথা বলে, মহানন্দে কাটল সন্ধ্যেটা। যত রাত বাড়ল, তত নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, গল্পের মাধ্যমে বাঙালিয়ানায় মুখর হল মহাসপ্তমী।
সপ্তমীর ভোগ খেয়ে যখন ঠাণ্ডায়ে কাঁপতে কাঁপতে ডীবুর্গের দিকে রওনা দিলাম, তখন কলকাতার রাস্তার আলো, ভীড়, রোশনাইয়ের থেকে অনেক দূরেও একটা সামাজিক তৃপ্তি পেলাম। অষ্টমীর জন্য মুখিয়ে রইলাম। আর অষ্টমীর শেষে যখন বাসে চেপে বাসস্থান হানোফারের দিকে রওনা দিলাম, তখন দেশের বাইরে প্রথম পূজোয় ইতি টানা হল, আর মন বলে উঠল, “আসছে বছর আবার হবে।”
দারুণ লিখেছ, সত্যিই আসছে বছর আবার হবে।
LikeLiked by 1 person